যাকাত একটি ফরজ ইবাদত যা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। এটি মুসলমানদের উপর আরোপিত একটি বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক ইবাদত, যা নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলে প্রদান করতে হয়। যাকাত ফরজ হওয়ার কিছু শর্তাবলী রয়েছে, যা নিম্নে বর্ণনা করা হলো -
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী
মুসলিম হওয়া
• যাকাত শুধুমাত্র মুসলমানদের উপর ফরজ। একজন অমুসলিমের উপর যাকাত ফরজ নয়।
স্বাধীন হওয়া
• যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ব্যক্তির স্বাধীন হতে হবে। দাসদের উপর যাকাত ফরজ নয়।
বয়স্ক হওয়া
• যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ব্যক্তির প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগ) হতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপর যাকাত ফরজ নয়, যদিও তাদের সম্পদের যাকাত তাদের অভিভাবক প্রদান করতে পারেন।
আকিল হওয়া
• যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ব্যক্তির সচেতন (আকিল) হওয়া আবশ্যক। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়।
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া
• যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ব্যক্তির নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। নিসাব হলো ন্যূনতম সম্পদের পরিমাণ যা যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য প্রয়োজন। বর্তমানে নিসাবের মান হলো ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ বা ৫৯৫ গ্রাম রূপা বা এর সমপরিমাণ সম্পদ।
হাওলানুল হাওল (এক বছর পূর্ণ হওয়া)
• যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক পূর্ণ হিজরি বছর (হাওল) ধরে মালিকানায় থাকতে হবে। যদি বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সম্পদ নিসাব পরিমাণে না থাকে, তাহলে যাকাত ফরজ হবে না।
যাকাতের হার
• যাকাতের হার হলো ২.৫%। অর্থাৎ, নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে তার উপর ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে।
কুরআনের দলিল
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
উচ্চারণ:
ইন্নাল্লাযীনা আমানু ওয়া আমিলুস সালিহাতি ওয়া আকামুস সালাতা ওয়া আতাউয যাকাতা লাহুম আজরুহুম ইন্দা রাব্বিহিম ওয়ালা খাওফুন আলাইহিম ওয়ালা হুম ইয়াহজনুন।
অর্থ:
নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যাকাত প্রদান করেছে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার রয়েছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।
[সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৭]
হাদিসের দলিল
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন -
بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ
উচ্চারণ:
বুনিয়াল ইসলামু আলা খামসিন: শাহাদাতি আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ, ওয়া ইকামিস সালাতি, ওয়া ইতা’ইয যাকাতি, ওয়াল হাজ্জি, ওয়া সাওমি রামাদান।
অর্থ:
ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত: এ সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; নামাজ প্রতিষ্ঠা করা; যাকাত প্রদান করা; হজ পালন করা এবং রমজান মাসের রোজা রাখা।
[সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম]
সারসংক্ষেপ -
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী হলো:
• মুসলিম হওয়া
• স্বাধীন হওয়া
• প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
• সচেতন হওয়া
• নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া
• এক বছর পূর্ণ হওয়া
যদি একজন ব্যক্তি এই শর্তাবলী পূরণ করেন, তাহলে তার উপর যাকাত ফরজ হয় এবং তাকে তার সম্পদের ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে। যাকাত ইসলামের একটি ফরজ ইবাদত এবং এটি মুসলমানদের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক দায়িত্ব।
যাকাতের হিসাব করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়মাবলী রয়েছে যা একজন মুসলিমকে তার সম্পদের উপর ভিত্তি করে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করতে সহায়তা করে। নিচে যাকাতের পরিমাপ করার বিস্তারিত পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
যাকাতের হার -
• যাকাতের হার হলো ২.৫%। অর্থাৎ, নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে তার উপর ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে।
যাকাতের জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ -
• স্বর্ণের নিসাব: ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ বা এর সমমূল্য সম্পদ।
• রূপার নিসাব: ৫৯৫ গ্রাম রূপা বা এর সমমূল্য সম্পদ।
যাকাতের হিসাব করার ধাপসমূহ -
মোট সম্পদের মূল্য নির্ধারণ
আপনার মোট সম্পদ হিসাব করুন, যা অন্তর্ভুক্ত করবে:
• নগদ অর্থ (ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, হাতে নগদ ইত্যাদি)
• সোনা ও রূপা
• ব্যবসার মালামাল (যদি আপনি ব্যবসা করেন)
• বিনিয়োগ (শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি)
• প্রাপ্য অর্থ (যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আপনার কাছ থেকে ঋণগ্রস্ত থাকে এবং আপনি তা আদায় করবেন বলে প্রত্যাশা করেন)
ঋণ ও দায় মাইনাস করা -
আপনার মোট সম্পদ থেকে সমস্ত ঋণ ও দায় মাইনাস করুন যা আপনি পরিশোধ করবেন:
• ব্যক্তিগত ঋণ
• ব্যবসায়িক ঋণ
নিসাব পরিমাণ নির্ধারণ -
যদি ঋণ ও দায় মাইনাস করার পর আপনার সম্পদের পরিমাণ নিসাব পরিমাণে পৌঁছে এবং এক বছর পূর্ণ হয়, তাহলে আপনার উপর যাকাত ফরজ হবে।
যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ -
যদি আপনার সম্পদ নিসাব পরিমাণে পৌঁছে এবং এক বছর পূর্ণ হয়, তাহলে যাকাতের হার অনুযায়ী যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করুন:
• যাকাতের হার: ২.৫%
• যাকাতের পরিমাণ: (মোট সম্পদ - ঋণ ও দায়) × ২.৫%
উদাহরণস্বরূপ যাকাতের হিসাব -
আপনার কাছে মোট সম্পদ রয়েছে:
• নগদ অর্থ: ১০,০০,০০০ টাকা
• স্বর্ণ: ৫০ গ্রাম (যার মূল্য ৬০,০০০ টাকা)
• ব্যবসার মালামাল: ৫,০০,০০০ টাকা
• বিনিয়োগ: ২,০০,০০০ টাকা
মোট সম্পদ: ১০,০০,০০০ + ৬০,০০০ + ৫,০০,০০০ + ২,০০,০০০ = ১৭,৬০,০০০ টাকা
আপনার ঋণ ও দায় -
• ব্যক্তিগত ঋণ: ৩,০০,০০০ টাকা
• ব্যবসায়িক ঋণ: ২,০০,০০০ টাকা
মোট ঋণ ও দায়: ৩,০০,০০০ + ২,০০,০০০ = ৫,০০,০০০ টাকা
নিট সম্পদ: ১৭,৬০,০০০ - ৫,০০,০০০ = ১২,৬০,০০০ টাকা
যাকাতের পরিমাণ: ১২,৬০,০০০ × ২.৫% = ৩১,৫০০ টাকা
সারসংক্ষেপ -
যাকাতের পরিমাপ করার জন্য মোট সম্পদ থেকে ঋণ ও দায় মাইনাস করে নিসাব পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। যদি সম্পদের পরিমাণ নিসাব পরিমাণে পৌঁছে এবং এক বছর পূর্ণ হয়, তাহলে যাকাতের হার অনুযায়ী ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে। যাকাত ইসলামের একটি ফরজ ইবাদত এবং এটি মুসলমানদের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক দায়িত্ব।