জগতের সব আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে, সব মোহ–মায়া ত্যাগ করে, সব বাধা বন্ধন উপেক্ষা করে একান্তভাবে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সন্নিধানে যাওয়ার নাম ইতিকাফ। ‘ইতিকাফ’ অর্থ অবস্থান করা, আবদ্ধ করা, আবদ্ধ হওয়া বা আবদ্ধ রাখা। পরিভাষায় ইতিকাফ হলো ইবাদতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখা। যিনি ইতিকাফ করেন, তাঁকে ‘মুতাকিফ’ বলে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৫)। আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) আজীবন রমাদান মাসের শেষ দশকগুলো ইতিকাফ করেছেন। তাঁর ওফাতের (আগে) পরেও তাঁর বিবিগণ (ঘরে) ইতিকাফ করতেন। (বুখারি ও মুসলিম; আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৪৬, পৃষ্ঠা: ১২৯)। ইতিকাফ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। রমজানের শেষ দশক তথা ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়া বা ৩০ রমাদান পূর্ণ হয়ে ওই দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ কিফায়াহ। কোনো মসজিদ মহল্লায় কয়েকজন বা কোনো একজন আদায় করলে সবাই দায়মুক্ত হবে। আর কেউই আদায় না করলে সবাই সুন্নাত তরকের দায়ে দায়ী থাকবে। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যিনি বা যাঁরা আদায় করবেন, শুধু তিনি বা তাঁরাই সওয়াবের অধিকারী হবেন। দশ দিনের কম যেকোনো পরিমাণ সময় ইতিকাফ করলে তা নফল ইতিকাফ হিসেবে গণ্য হবে। নফল ইতিকাফও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ নেক আমল; তাই সম্পূর্ণ সুন্নাত ইতিকাফ পালন করতে না পারলে যত দূর সম্ভব নফল ইতিকাফ করাও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শবে কদর প্রাপ্তি; রমাদানের শেষ দশক ইতিকাফ করলে শবে কদর প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। নফল ইতিকাফ বছরের যেকোনো সময়ই করা যায়। ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত; কিন্তু স্বল্প সময় (এক দিনের কম সময়) ইতিকাফ করলে তার জন্য রোজা রাখা শর্ত নয়। নফল ইতিকাফ (রোজাসহ কমপক্ষে এক দিনের জন্য) মান্নত করলে বা আরম্ভ করে ছেড়ে দিলে, তা পূর্ণ করা ওয়াজিব। এর জন্য রোজা শর্ত এবং এটি এক দিনের (২৪ ঘণ্টা) কমে হবে না। যেকোনো দিন সূর্যাস্তের পূর্ব হতে পরের দিন (রোজাসহ) সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইতিকাফ করলে পূর্ণ এক দিন ইতিকাফ হয়। সাধারণত পুরুষদের মসজিদে ইতিকাফ করতে হয়; মহিলাগণ নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে ইতিকাফ করবেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও একান্ত বিশেষ জরুরত ছাড়া ওই ঘর বা কক্ষ থেকে বের হবেন না। অজু ইস্তিঞ্জা বা পাকপবিত্রতার জন্য বাইরে বের হলে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন না বা সালাম কালাম করবেন না। কেউ সালাম দিলে তার জওয়াবও দেবেন না। তবে দরকার হলে ওই কক্ষের ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবেন এবং কেউ ভেতরে এলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবেন। ইতিকাফ কক্ষে এমন কেউ অবস্থান করতে পারবেন, যাঁরা ইতিকাফ করছেন না। ইতিকাফ কক্ষটি যদি শয়নকক্ষ হয় এবং একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যে কেউ অবস্থান করেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই; এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন; তবে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ; এর দ্বারা ইতিকাফ
ভঙ্গ হয়ে যাবে। ইতিকাফের সময় ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ো না, যখন তোমরা ইতিকাফরত থাকবে মসজিদে (বা নির্দিষ্ট স্থানে)। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। ইতিকাফ অবস্থায় ইতিকাফকারী ফরজ ইবাদতের বাইরে কোনো নফল ইবাদত না করলেও ইতিকাফের সওয়াব পাবেন। তবে অতিরিক্ত নফল ইবাদত করলে আরও বেশি ফজিলতের অধিকারী হবেন। যেমন কোরআন কারিম তিলাওয়াত করা, নফল নামাজ পড়া, কাজা নামাজ আদায় করা, দোয়াদরুদ পাঠ করা, জিকির আসকার করা, তাসবিহ তাহলিল পাঠ করা, জিকির আসকার ও তাওবাহ ইস্তিগফার করা। এ ছাড়া দীনি কথাবার্তা ও ধর্মীয় জ্ঞান চর্চা করাও সওয়াবের কাজ। যেমন কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, তাফসির ইত্যাদি পাঠ করা ও তালিম করা। ইতিকাফ অবস্থায় এমন সব কথা বলা ও কাজ করা বৈধ, যাতে কোনো গুনাহ নেই। প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা বলতেও নিষেধ নেই; তবে অহেতুক অযথা বেহুদা অনর্থক কথাবার্তা বলা যাবে না। ইতিকাফকারী মসজিদে বা ইতিকাফের স্থানে সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবেন এবং মাথায়, দাড়িতে ও চুলে তেল লাগাতে পারবেন। মাথার চুলে ও দাড়িতে চিরুনিও ব্যবহার করতে পারবেন। (খোলাসাতুল ফিকহ)। যিনি নিয়মিত যে আমল করেন অথবা কোনো নেক আমলের নিয়ত করেন, বিশেষ কোনো ওজরের কারণে তা করতে না পারলেও তার সওয়াব পাবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মসজিদে ইতিকাফ করতে না পারলে, নির্দিষ্ট স্থানে অনুরূপ অবস্থান করলেও বিশেষ সওয়াবের আশা করা যায়।