আরাফাতের দিন বা আরাফার দিন (আরবি: يوم عرفة) ইসলামের একটি পবিত্র দিন যেটি এই ধর্মের পরিপূর্ণতা লাভের দিবস হিসেবে পরিচিত। এই দিনটি ইসলামিক চন্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে জিলহজ মাসের ৯ তারিখে সংগঠিত হয়, যা রমজান মাস শেষ হওয়ার প্রায় ৭০ দিন পর ঘটে। এই দিনটির শেষ ভাগে, মুসলিম হজ্জ্ব যাত্রীরা মিনা থেকে যাত্রা করে নিকটবর্তী পাহাড়ের সন্নিকটবর্তী-সমভূমি আরাফাতের ভূমিতে এসে উপস্থিত হন। এই দিনটিতেই মুহাম্মদ (স.) তার জীবনের শেষ বছর বিদায় ভাষন দিয়েছিলেন।
(১) আরাফায় পৌঁছে মসজিদে ‘নামিরা’র কাছে অবস্থান করা মুস্তাহাব অর্থাৎ উত্তম। সেখানে জায়গা না পেলে আরাফার সীমানার ভিতরে যে কোন স্থানে অবস্থান করতে পারেন। এতে কোন অসুবিধা নেই- (মুসলিম)। তবে পাশেই ‘উরানা’ নামের একটি উপত্যকা আছে। সেটি আরাফার চৌহদ্দির বাইরে। কাজেই সেখানে যাবেন না। ঐখানে অবস্থান করবেন না।
(২) যুহরের সময় হলে ইমাম সাহেব খুৎবা দেবেন। খুৎবার পর যুহরের ওয়াক্তেই যুহর ও আসরের সালাত একত্রে জমা করে পড়বেন। দু’ নামাযেরই আযান দেবেন একবার, কিন্তু ইকামাত দেবেন দু’বার। কসর করে পড়বেন। অর্থাৎ যুহর দু’রাকআত এবং আসরও দু’রাকআত পড়বেন। যুহরের ওয়াক্তেই আসর পড়ে ফেলবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসী ও বহিরাগত সব হাজীকে নিয়ে একত্রে এভাবে নামায পড়িয়েছিলেন। এটা সফরের কসর নয়, বরং হজ্জের কসর। কোন নফল-সুন্নাত নামায আরাফায় পড়বেন না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়েননি।
(৩) মসজিদে নামিরায় যেতে না পারলে নিজ নিজ তাবুতেই উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে জামা‘আতের সাথে যুহর-আসর একত্রে যুহরের আউয়াল ওয়াক্তে দুই দুই রাক‘আত করে কসর ও জমা করে পড়বেন।
(৪) আরাফার ময়দানের সীমানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে অবশ্যই আরাফার পরিসীমার ভিতরে অবস্থান করতে হবে। আরাফার সীমানা চিহ্নিত করে চতুষ্পার্শে অনেক পিলার দেয়া আছে। এর বাইরে অবস্থান করলে হজ্জ হবে না।
(৫) সুন্নাত হলো বেশী বেশী দোয়া করা, দোয়ার সময় হাত উঠানো, অত্যন্ত বিনম্র হওয়া, যিকর করা, তাসবীহ পড়া, ‘আলহাম্দুলিল্লাহ’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়া, তাওবাহ করা, কান্নাকাটি করে গোনাহ মাফ চাওয়া, মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য বেশী বেশী দোয়া করা।
তাছাড়া নীচের দোয়াটি আরো বেশী বেশী পড়া উত্তম-
এছাড়া নীচের তাসবীহটি বেশী বেশী পড়বেন-
(৬) যখন সূর্য ডুবে যাবে এবং সূর্য অস্ত গিয়েছে এরূপ নিশ্চিত হবেন তখন প্রশান্ত মনে ধীরে সুস্থে মুযদালিফায় রওয়ানা দেবেন। এ সময় বেশী বেশী তালবিয়াহ পড়তে থাকবেন। সাবধান, কোন অবস্থাতেই সূর্যাস্তের আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করা যাবে না।
(১) এ তারিখে দিনের বেলায়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হন।
(২) আল্লাহর কাছে ঐ দিনের চেয়ে উত্তম আর কোন দিন নেই।
(৩) বান্দাদের জন্য আল্লাহ তাঁর দয়ার ভান্ডার খুলে দেন।
(৪) সেদিন আল্লাহ বান্দাদের অতি নিকটবর্তী হন।
(৫) আরাফাতে অবস্থানকারী ও মাশআরুল হারাম- বাসীকে আল্লাহ সেদিন ক্ষমা করে দেন।
(৬) উমর রাদিআল্লাহু আনহুর প্রশ্নের জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আরাফায় আগমনকারীদের জন্য এ ক্ষমা প্রদর্শন কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে।
(৭) যমীনবাসীদের নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের সাথে গৌরব করে বলেন, ‘‘আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ তারা ধূলিমলিন অবস্থায় এলোকেশে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে আমার রহমতের আশায়, অথচ আমার আযাব তারা দেখেনি। কাজেই আরাফার দিনে এত অধিক সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে আমি মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি যা অন্যদিন তারা পায়নি।
(৮) শয়তান ঐদিন সবচেয়ে বেশী লাঞ্ছিত, হীন ও নিকৃষ্ট বনে যায় এবং তাকে ক্রোধান্বিত দেখা যায়। বান্দাদের দোয়া কবূল ও যিকরের মাধ্যমে শয়তানকে বেদনাবিধুর করে দেয়া হয়।
(৯) আল্লাহ সেদিন বলেন, এরা কি চায়? অর্থাৎ হাজীরা যা চায় তাই তিনি দিয়ে দেন।
(১০) সেদিন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং রহমত বর্ষিত হয়।
আদবগুলো নিম্নরূপঃ
(১) গোসল করে নেয়া,
(২) পরিপূর্ণ পবিত্র থাকা,
(৩) কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা ও অন্যান্য তাসবীহ পড়া,
(৪) দোয়া, তাসবীহ ও তাওবা-ইস্তিগফারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া,
(৫) নিজের ও অন্যদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জাহানের কল্যাণ ও মুক্তি চেয়ে দোয়া করা,
(৬) দু’হাত উঠিয়ে দোয়া করা,
(৭) মনকে বিনম্র ও খুশু-খুযু রেখে মুনাজাত করা,
(৮) দোয়াতে কণ্ঠস্বর নীচু রাখা, উচ্চঃস্বরে দোয়া না করা।
দুপুরে সূর্য পশ্চিমে ঢলার পর থেকে আরাফার প্রকৃত সময় শুরু হয়। তবে ইমাম হাম্বলের মতে সেদিনের সকালের ফজর উদয় হওয়া থেকেই এ সময় শুরু হয়। আর এর শেষ সময় হল আরাফার দিবাগত রাত্রির ফজর উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
দিনে অবস্থানকারীর সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা।
অনেক হাজী আরাফার দিন কিছু ভুল করে থাকেন, যা সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করা উচিত। তন্মধ্যে কিছু ভুল হল-
•আরাফার সীমানার বাইরে অবস্থান করা: অনেক হাজ্বীকে দেখা যায়, সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার বাইরে যেখানে জায়গা পায় সেখানেই অবস্থান করে এবং সেখান থেকেই মুযদালিফা চলে যায়। এমনটি করলে তার হজ্বই হবে না।
•সূর্যাস্তের পূর্বেই আরাফা থেকে রওনা হয়ে যাওয়া। এটা জায়েয নেই। কারণ এটা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নত বিরোধী কাজ।
•জাবালে রহমাতে উঠতে এবং এর চূড়ায় পৌঁছতে ভিড় সৃষ্টি করা,
•ধাক্কা-ধাক্কি করা। সেখানে হাত লাগিয়ে নিজের পায়ে মুছা, সে জায়গ- ায় সালাত আদায় করা। এ কাজগুলো সবই বিদআত, শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। সাথে সাথে এ সব কাজে শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতিতো হয়েই থাকে।
•আরেকটি প্রচলিত ভুল হলো দোয়ার সময় জাবালে রহমতের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো।
দোয়া করার সুন্নত নিয়ম হলো; কেবলামুখী হয়ে দোয়া করা।